বুদ্ধিজীবী হত্যার অনুমোদন
রাও ফরমানের ফরমান, ‘এদের হত্যা করো’
প্রকাশিত : ১০:৩৯, ১২ ডিসেম্বর ২০২১
গতকাল নিক্সন ঘোষণা করেছিলেন, ‘১২ ডিসেম্বর দুপুরের আগেই ভারতেকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করা হবে।’ খুশি পাকিস্তান। লে জে নিয়াজিকে খবরটি জানালেন আরেক লে জে গুল হাসান। গুল বললেন, ‘আর একটা দিন। উত্তর-দক্ষিণ থেকে কালই এসে যাচ্ছে বন্ধুরা।’ একথা শোনার পর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন নিয়াজি। ঢাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ২৪ ঘণ্টার জন্য ঢাকায় কারফিউ জারি করা হলো।
এদিকে আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তেজনা সামনে এসে দাঁড়ায় ১২ ডিসেম্বর।
নিক্সনকে বার্তা পাঠায় ব্রেজনেভ সরকার, ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সরকার কোনো সামরিক ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয়।
নিক্সনকে কিসিঞ্জার বললেন, ‘এটা সুখবর। তবে ভারতের এই নিশ্চয়তার মধ্যে স্পষ্টতার ঘাটতি আছে।’
নিক্সন জানতে চাইলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানো কত দূর?’
কিসিঞ্জার বললেন, ‘সব কিছু ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানে চারটি যুদ্ধবিমান রওনা হয়েছে, আরও ২২টি যাবে। সৌদি আরব ও তুরস্কের সঙ্গে কথা বলেছি। তুরস্ক পাঁচটি যুদ্ধবিমান দেবে।’
মুখে হাসি ফুটল নিক্সনের।
আমেরিকার নৌবহর রওনা হওয়ার খবর সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার জানা ছিল।
পাল্টা ব্যবস্থা নেয় রাশিয়া। ভারত মহাসাগরে প্রথম টাস্কফোর্স পাঠায় সপ্তম নৌবহরকে মোকাবিলা করতে। আবার, দ্বিতীয় টাস্কফোর্সকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
সপ্তম নৌবহর যেন ঠিকমতো ভিড়তে না পারে, সেজন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট-বড় সকল নৌযানসহ উপকূলের অবকাঠামো ধ্বংস করা হলো। সবমিলে দিল্লীতে উত্তেজনা। বিশেষ সভায় বসলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ‘সামনের অন্ধকার দিন’ আর ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করলেন। নিক্সনের চরমপত্র প্রত্যাখান করে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানিয়ে দিলেন, ‘ভারত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এবং ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে, যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছতে রাজি হয়, তবেই।’
২
এদিকে আজ শত্রুমুক্ত হলো কুমিল্লার চান্দিনা।
ময়নামতি সেনানিবাসে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে বরুড়া হয়ে চান্দিনার উপর দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। যাবার সময় বিভিন্ন স্থানে হামলা, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর এলে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যায়। হারং উদালিয়ার পাড় এলাকায় পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনার গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ভোরে আত্মসমর্পণ করে প্রায় ১৭ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা।
পাকিস্তানিদের ধরে নিয়ে আসে চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।
আবার, গতকাল হারং উদালিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়ায় ছয়জন পাকিস্তানি সৈন্য পালিয়ে যাওয়ার সময় করতলা গ্রামে সাধারণ মানুষ ধাওয়া দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি ছুড়তে শুরু করে। এসময় দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ চারজন শহীদ। আর, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে খতম হয় ছয়জন পাকিস্তানি সেনা।
সকালে নরসিংদীতে পতন হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের। বিকেলে মিত্রবাহিনীর একটি শক্তিশালী ইউনিট এসে হাজির হয় ডেমরা ঘাটের কাছাকাছি।
জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে মিত্রবাহিনীর প্যারাসুট ব্যাটেলিয়ান এসে পৌঁছে টাঙ্গাইলে।
শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রবল আক্রমণ হলো মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও এর আশেপাশে পাকিস্তানিদের সেনাক্যাম্পে। সঙ্গে থাকলো কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। এই যুদ্ধের সাফল্য ঢাকা আক্রমণের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়।
যুদ্ধ চলছে দিনাজপুরের খানসামায়। এখানে খতম হয় ১৫ পাকিস্তানি। শহীদ হলেন সাতজন মুক্তিযোদ্ধা। আটক হয় এক পাকিস্তানি মেজরসহ ১৯ জন।
রক্তে ভিজে যায় দিনাজপুরের বিরল। বহলা গ্রামে গণহত্যা চালায় হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য।
শত্রুমুক্ত হলো নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, গাজীপুরের শ্রীপুরসহ আরো বেশ কিছু এলাকা।
৩
রাতে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আলবদর-আলশামসের কেন্দ্রীয় নেতাদের ডেকে পাঠালেন সদর দপ্তরে। গোপন বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্য-ষড়যন্ত্র পাকা করলেন ফরমান আলী। আলবদর আলশামস নেতাদের হাতে তুলে দিলেন বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা। নির্দেশ, ‘এদের হত্যা করো।’
এসএ/